স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বেশির ভাগ বই ইংরেজিতে লেখা। স্কুল-কলেজে যাঁদের ইংরেজির ভিতটা ভালোভাবে গড়ে ওঠে না, হঠাৎ করেই ইংরেজি মাধ্যমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খান তাঁরাস্কুল-কলেজে বাংলা মাধ্যমে পড়ে আসা অনেক শিক্ষার্থীরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ‘লেকচার’ বুঝতে সমস্যা হয়। আদৃতা (ছদ্মনাম) স্কুল-কলেজে বাংলা মাধ্যমে পড়েছেন। এরপর ভর্তি হয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে। নতুন ক্যাম্পাস, নতুন বন্ধু…ভালোই চলছিল । কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর মধ্যে ক্লাসভীতি জন্মে গেল। কেন? কারণ স্নাতক পর্যায়ের বইগুলোর সবই ইংরেজি ভাষায়লেখা। শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ান ইংরেজি ভাষায়। আদৃতা হয়তো একটা কিছু বুঝতে পারছেন না, প্রশ্ন করবেন ভাবছেন। কিন্তু ইংরেজিতে প্রশ্নটা করতে গিয়ে ব্যাকরণে ভুল হয়ে যাবে না তো! এই শঙ্কায় আর মুখ খোলা হয় না। বাংলা বা ইংরেজি যে ভাষায়ই হোক, শিক্ষকেরা সব সময় প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেন। কিন্তু আদৃতা যে ভালো ইংরেজি জানেন না, সহপাঠীদের সামনে এই ব্যাপারটা ‘ফাঁস’ করতে চান না। পাছে যদি ক্লাসের বন্ধুরা তাঁকে ‘খ্যাত’ ভেবে বসেন! তাঁর আপত্তির কারণেই এই প্রতিবেদনে মন্তব্যটা ছদ্মনামে লিখতে হলো।

আদৃতার মতো প্রায় একই সমস্যায় ভুগছেন দেশের বহু শিক্ষার্থী। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বেশির ভাগ বই ইংরেজিতে লেখা। স্কুল-কলেজে যাঁদের ইংরেজির ভিতটা ভালোভাবে গড়ে ওঠে না, হঠাৎ করেই ইংরেজি মাধ্যমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খান তাঁরা।

‘উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল বেশ আগে। কিন্তু বাজারের চাহিদার কারণে ইংরেজি পড়াতে হচ্ছে’, বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শাদমান সাকিব অবশ্য জানালেন, বইগুলো ইংরেজিতে লেখা হলেও তাঁদের শিক্ষকেরা ক্লাসে বাংলায় পড়ান। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র তিনি। বইয়ের পড়া বুঝতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে ঠিক। কিন্তু শাদমান আশা করছেন, দ্রুতই এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

কিন্তু যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বাংলায় হয় না, তাঁদের অবস্থা কেমন? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাফিউজ্জামান চঞ্চল বলছিলেন, ‘প্রথম দিন ক্লাসে গেছি। স্যার ক্লাসে এসে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করলেন। আমার অবস্থা বেগতিক। একে তো মাইক্রো বায়োলোজির টার্ম বুঝি না, তার ওপর স্যারের উচ্চারণ ধরতে পারছিলাম না।’ সমস্যাটা অবশ্য দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছেন তিনি। কীভাবে? সেটা শুনব। আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুমু বড়ুয়ার সংকটটা শোনা যাক। তাঁর সমস্যা শুধু ইংরেজিই নয়, ‘লিগ্যাল ইংরেজি’। সেটা কী? মুমু বলেন, ‘লিগ্যাল রিসার্চ ম্যাথলজিতে আমাদের ল্যাটিন শব্দে ইংরেজি পড়তে হয়।’ জানালেন, এই বিষয় পড়তে গিয়ে তাঁকে বেশ সমস্যা পোহাতে হয়েছে। তবু তিনি বাংলায় পড়ার চেয়ে একটু কষ্ট করে ইংরেজিটা ভালোভাবে শিখে নেওয়ার পক্ষে। কারণ, উচ্চতর ডিগ্রি নিতে দেশের বাইরে পড়তে গেলে ইংরেজির বিকল্প নেই।

প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটা ক্লাসেই ‘ইংরেজি’ বিষয়টা থাকে। একটা ভাষা ১২ বছর ধরে শেখার পরও কেন শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হয়? প্রশ্ন করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্যের কাছে। তাঁর মতে, সমস্যা দুইটি। প্রথমত, ইংরেজি শেখানোর পদ্ধতি; দ্বিতীয়ত, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দক্ষ শিক্ষকের অভাব। আরেকটি সংকটের কথা তুলে ধরেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলছেন, ‘আমাদের যে ইংরেজি শেখানো হয়, সেটা আসলে অনেকটা দেশীয় ইংরেজি। এর ফলে যখন শিক্ষার্থীরা স্নাতক পর্যায়ে পড়া শুরু করছে, সেখানে গিয়ে আকাশ থেকে পড়ছে। কারণ, তার হাতে যে বইটি, সেটি আন্তর্জাতিক মানের। দেশে ভালো অনুবাদক নেই। একটি বইয়ের মান ধরে রেখে তার অনুবাদ করার জন্য যে দক্ষতা থাকা দরকার, সেটা নেই। তাই যদি ইংরেজিতেই শিক্ষার্থীদের পড়াতে হয়, সেই অনুয়ায়ী সিলেবাস ও শিক্ষক থাকা প্রয়োজন।’ তাঁর কথার প্রমাণ পাওয়া গেল মুমু বড়ুয়ার কাছে। বলছিলেন, ‘লিগ্যাল ইংরেজি কঠিন লাগছিল বলে বইটির একটা বাংলা অনুবাদ সংগ্রহ করেছিলাম। ওই অনুবাদ ইংরেজির চেয়েও কঠিন ছিল!’

বাংলায় পড়াতে পারলেই ভালো হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। তাঁর মতে, ‘বাংলা হলো মনের ভাষা। এই ভাষায় পড়লে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমে, তারা দ্রুত শিখতে পারেন। এখন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় যা লেখে, তা তো অনেকটা বাংলার মতোই। ভাষাগত ভু

লত্রুটি বিবেচনা করলে অনেক শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না তারা।’ এই সমস্যা থেকে উতরানোর উপায় কী? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাফিউজ্জামান চঞ্চল যেমন ক্লাসগুলো কঠিন মনে হলেও নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন। গল্পের বইয়ের মতো পাঠ্যবই পড়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতো অনেক শিক্ষার্থীই এই বিপাকের ‘সুযোগ’ কাজে লাগিয়ে ইংরেজির ভয়কে জয় করেছেন। তবে বুয়েটের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনের বক্তব্য, ‘ইংরেজি ভালোভাবে শিখতে হলে বাংলাটা ভালো জানা দরকার। কারণ, আমরা তো প্রথমে বাক্যটাকে মনে মনে বাংলায় সাজাই তারপর ইংরেজি করি।’